আল্লাহর জন্য প্রিয় জিনিসকে ছাড়া

আবু তালহা (রা) রসূল করীম (স) এর মজলিসে তাশরিফ আনলেন। রসূল (স) ঐ মজলিসের মধ্যে কুরআন শরীফের এই আয়াত পড়লেন-

لَن تَنَالُواْ الْبِرَّ حَتَّى تُنفِقُواْ مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنفِقُواْ مِن شَيْءٍ

“তোমরা যা ভালবাস, তা হতে ব্যয় না করা পর্যন্ত তোমরা কখনই কল্যাণ লাভ করতে পারবে না”-সুরা আল-ইমরানঃ ৯২

আবু তালহা (রা) জিজ্ঞেস করলেন- “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহ তা’আলা কি আমাদের কাছে আমাদের প্রিয় জিনিস চান?” রসূল (স) বললেন-“হ্যাঁ”। আবু তালহা (রা) বললেন- “আমার কাছে আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা হল “বাইরুহা”। এটা একটা বাগান, যেখানে ঝরনাও আছে, খুব ভালো পানি। রসূল করীম (স) ঐ বাগানে যান, ঐ পানি পান করেন, ঐখানে বসেন, ওযূ করেন। তো আবু তালহা (রা) বললেন-“এটিই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস। আমি এটাই আল্লাহর ওয়াস্তে সদকা করলাম”। রসূল করীম (স) কবুল করলেন আর উনার আত্নীয়দের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়ার জন্যে বললেন। লক্ষণীয়, সাহাবারা আল্লাহকে যে চাচ্ছেন- কিছু দিয়ে, আর শুধু দিয়ে নয়, প্রিয় জিনিস দিয়ে।

বারাহ বিন আযেব (রা), ইয়ামামার যুদ্ধের সময় উনার কাছে সবাই এসে বললেন যে, রসূল করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে মুসতাযাবুত দু’আ বলেছেন। আপনি দু’আ করুন আল্লাহ তাআ’লা যেন আমাদেরকে ফাতাহ দেন। তখন মুসলমানরা খুব বিপদের মধ্যে। মুসায়লাবা কাযযাবের বাহিনী খুব জোর আক্রমণ চালিয়েছে। অনেক সাহাবী (রা) শহীদ হয়ে গেছেন, আর মোকাবিলায় যেন পারছেন না। ঐ সময় তারা চিন্তা করলেন যে বারাহ বিন আযেব (রা) এর কাছ থেকে গিয়ে আমরা দু’আ চাইব। রসূল করীম (স) তার ব্যাপারে বলেছেন যে তার দু’আ মুসতাযাবুত। তো উনারা এলেন; এসে উনার কাছে বললেন আর উনি দু’আ করতে রাজি হলেন। কিন্তু নিজে থেকেই আরেকটা কথা বাড়িয়ে দিলেন। দু’আ করলেন,“আল্লাহ! মুসলমানদেরকে ফাতাহ দাও আর আমাকে শাহাদত দাও”। তো তাই হল। উনার দু’আ কবুল হল। মুসলমানরা ফাতাহ পেলেন আর উনি শাহাদত পেয়ে গেলেন। তারা তো উনার কাছ থেকে শুধু ফাতাহর দু’আই চেয়েছিলেন, এইটা উনি আবার বাড়িয়ে দিলেন কেন?

উনি যে মুসতাযাবুত দু’আ হয়েছেন দু’আর আদব জানেন বলেই উনার দু’আ মুসতাযাবুত। আর এটাই দু’আর আদব। কিছু দিয়ে কিছু চাইতে হয়। আর মূল্যবান কিছুই দিতে হয়। জিনিসের দিক থেকে আবু তালহা (রা) উনার সবচেয়ে প্রিয় মূল্যবান সম্পত্তি দিলেন, বারাহ (রা) উনার জীবন দিলেন।

তো সাহাবাদের (রা) কাছে দেওয়া কখনও কখনও শুধুই দেওয়া, বিনিময়ে যে কিছু চাচ্ছেন এরকম দেখা যায়না পরিষ্কার ভাবে। যেরকম ওহূদের যুদ্ধের আগে দু’আ করলেন আব্দুল্লাহ বিন জাহাশ (রা), যে আমাকে যেন কতল করে ফেলে, আমার নাক, কান কেটে ফেলে। এই কথা বলছেন না যে বিনিময়ে আমাকে এটা দিও। কিন্তু বুঝা যায় যে আল্লাহ তাআ’লার ভালোবাসা চাচ্ছেন। আল্লাহর ভালোবাসা চাচ্ছেন তো কিছু দিয়ে চাচ্ছেন। আর এখানে “বির” চাচ্ছেন, “লান তানালুল বির”-এটাও আল্লাহর সন্তুষ্টি। কিন্তু তোমার প্রিয় জিনিস দিয়ে, এখানে আল্লাহ তাআ’লা বলেই দিয়েছেন এটা আদব। বারাহ (রা) ফাতাহর দু’আ করছেন নিজের জীবন দিয়ে। নিজে থেকে বলছেন-“আমাকে শাহাদত দাও”।

আল্লাহ নিজেই বলেছেন “আমি কি তোমাদের ওপর চাপিয়ে দিব? আরোপ করে দিব? আর তুমি চাও না”। তো আল্লাহ তাআলা জবরদস্তি দিয়ে দিবেন না। আল্লাহ তাআ’লা তো দেবেন, কিন্তু আল্লাহ তাআ’লা চান যে আমি আগ্রহী কিনা?

আমরা বলছি, আমরা তো হেদায়াত চাই। ঐটার নাম চাওয়া নয়, যেহেতু আমি দাম দিতে রাজি না। আমরা তো চাই যে, ‘হে আল্লাহ, এমনি থেকেই দিয়ে দাও’। কিন্তু ঐ ভাবে এমনি থেকে যদি পেয়ে যায় তো কদরও করতে পারব না। যেরকম প্রচলিত কথা আছে- বাপের কাছ থেকে সম্পত্তি পাওয়া, ওটা তো গাঁজা খেয়েই উড়াবে। নিজে থেকে উপার্জন করুক তবে তার কদর জানবে। হেদায়াতের মত সম্পত্তি, সম্পদ- এটাকেও প্রিয় জিনিস দিয়ে নিতে হয়।

দুই ধরণের প্রিয় জিনিস আছে। এক ধরণের প্রিয় জিনিস হল যে আমার কাছে আছে। অপর দিকে মানুষের কাছে অনেক ধরণের কাল্পনিক প্রিয় জিনিসও থাকে। কাল্পনিক প্রিয় জিনিস যেমন থাকে তেমনি কাল্পনিক ভয়ের জিনিসও আছে। ভবিষ্যতে রাজা হবে- তার একটা কল্পনা। এই যে কল্পনা- সে উপভোগ করে। বর্তমান রাজা হওয়ার চেয়ে রাজা হওয়ার স্বপ্ন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনেক বেশি উপভোগ্য। রাজা যখন হয়ে যায় তখন অত মজা লাগেনা। নানান সমস্যা তার মধ্যে আছে। কিন্তু রাজার স্বপ্ন দেখার মধ্যে কোন সমস্যা নেই। মনে মনে আনন্দ করা যায়। ওরকম বর্তমান মুসিবতও অনেক ক্ষেত্রে কাল্পনিক মুসিবতের চেয়ে সহজ। অভাবের কারণে মানুষ যত কষ্ট পায়, সম্ভবত তার চেয়ে বেশি কষ্ট পায় ভবিষ্যতের কাল্পনিক বা সম্ভবপর অভাবের কারণে। “হায় কি হবে?! কি হয়ে গেছে প্রায়ই ঐটা তত বড় সমস্যা না। কিন্তু কি হবে বা ভবিষ্যতে কিছু একটা হয়ে যেতে পারে কল্পনা করেই মানুষ যত ভয় পায়।

ওরকমই বর্তমানে একটা সম্পদ আছে আর এইটাও আল্লাহকে দিয়ে তার মোকাবেলায় হেদায়াত চাওয়া, আর কল্পনার সম্পদ দিয়েও আল্লাহর কাছে হেদায়াত চাওয়া; এইটাও বহুত বড় কুরবানি। যেমন আমি কিছু একটা চাই মনে মনে, দু’আ করলাম ইয়া আল্লাহ এই জিনিস আমার মন বড় বেশি চায়, তুমি এইটা না দিয়ে আমাকে হেদায়াত দিয়ে দাও। আসলে আমার পকেট থেকে কিছুই যাচ্ছে না, কিন্তু সহজও নয়।

এইটুকু একটু ভূমিকা ছিল। এখন একটু তশকিলে আসতে চাই।

বর্তমান সম্পদ দিতে নাই বা পারলাম, কল্পনার সম্পদ দিয়ে দু’আ করি। যদি ঠিকই দু’আ করতে পারি, ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তাআ’লা বহুত বড় সম্পদ দিবেন। আর প্রত্যেকের কাছেই নিজ নিজ কল্পনা অনুযায়ী তার কিছু আছে। ছাত্র ভাল রেজাল্ট চায়, চাকরিজীবি প্রমোশন চায়, ব্যবসায়ী লাভ চায়, বন্ধু বান্ধবের কাছে সম্মান চায়, আত্মিয় স্বজনের কাছে কদর চায়। এরকম আরও কত নানান ধরণের জিনিস আছে। কিছু জিনিস আছে অনেক দিন ধরেই মনের মধ্যে আছে আর কিছু আছে অদল বদল হতে থাকে। এই যে আমার মনের মধ্যে অনেক কিছু আছে, আমি অনেক কিছুই চাই- খোঁজ করলে দেখা যাবে কিছু এমন আছে যার প্রাধান্য বেশি। অন্যান্য ছোট খাটো চাওয়ার মোকাবিলায় কিছু কিছু চাওয়া একটু বড় ধরণের, যেগুলো লেগেই থাকে। অনেকগুলোই ছিল যা সকালে চেয়েছি এখন ভুলে গেছি। আর কিছু আছে আজকেও চেয়েছি, গতকালকেও চেয়েছি, আগের দিনও চেয়েছি, লেগেই আছে। আর এইজন্য মনের মধ্যে প্ল্যান-পরিকল্পনা অনেক কিছুই আছে। যত বেশি বড় জিনিস আমার মনের মধ্যে আছে, ঐটার মোকাবিলায় যদি আল্লাহর কাছে দু’আ করতে পারি, যে আল্লাহ এই যে এই একটা জিনিস আমি অনেকদিন থেকে চাই, আমার মন বড় বেশি চায়, আর এজন্য আমি স্বপ্ন দেখি, কল্পনা করি, এই চারপাশে কল্পনার জগৎ গড়ে তুলেছি; এইটা আমি কুরবান করে দিলাম। আর এর বদলে তুমি আমাকে হেদায়াত দিয়ে দাও, তোমার সম্পর্ক নসিব কর, তোমার নৈকট্য দান কর, পথ দেখাও এই ধরণের…।

আবার বলছি, যদিও বাস্তবে কিছুই দিচ্ছি না, কিন্তু আমরা এতই কৃপণ যে কাল্পনিক জিনিসও সহজে দেওয়া যায়না। দিতে রাজি হইনা বরং ঘুরে ফিরে দু’আ করি, ‘হে আল্লাহ, দিয়ে তো দিলাম, তুমি আবার ফিরিয়ে দিও। [মজমা হেসে ফেলল]। ওরকম নয়. বরং একেবারে যত বেশি সাফ দিলে পারা যায়। কিন্তু ব্যাপারটা যেহেতু মনের ওপরে আঘাত নিয়ে আর সম্পূর্ণ দ্বীনই মনের ব্যাপার, এই জন্য এই দেওয়াও কিন্তু ছোট দেওয়া নয়। আর আল্লাহ তাআ’লা তো এই রকম কাল্পনিক জিনিসকে বড়ই কদর করেন।

মারিয়াম (আ) এর মা; উনার পেটে কাল্পনিক ছেলে বাস্তবে মেয়ে। মারইয়াম (আ) মেয়ে ছিলেন, মা ভাবছিলেন যে ছেলে। ঐ কল্পনার ছেলেকে তিনি বাইতুল মাক্কদিসের খেদমতের জন্য দিয়ে দিলেন। এটা নফসের বড় একটা ছাড়া। মানুষ তার ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে, আর উনি দিয়ে দিলেন যে বাইতুল মাক্কদিসের খাদেম হবে। আল্লাহ তাআ’লা কবুলও করলেন। তো দিলেন যেটা আসলে নয়, আল্লাহ তাআ’লা যেটা কবুল করলেন সেটাও আসলে নয়। আর তারপর আল্লাহ তাআ’লা বহুত বাড়িয়ে মারইয়াম (আ) এর কাছ থেকে ঈসা (আ) কে বাহির করলেন। বাইতুল মাক্কদিসের খাদেম উনি দিতে চেয়েছিলেন, আল্লাহ তাআ’লা কবুল করে ঐটা বহুত বড় করে বনী ঈসরাইলের বিরাট নবী বানিয়ে দিলেন। কোথায় মসজিদের খাদেম আর কথায় উম্মতের নবী।

তখন আবার মন বলবে যে – ঠিক আছে,আমি আমার মনের জিনিস আল্লাহর ওয়াস্তে কুরবানী করে দিই, আল্লাহ তাআ’লা নিয়ে গিয়ে মারইয়াম (আ) এর মত ডাবল করে আমাকে দিবেন! [মজমা হেসে ফেলে]। ঐরকম না; বরং সাফ দিলে। আবার ফেরত পাওয়ার লোভে নয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফীক নসিব করুক; আল্লাহর কাছে বড় প্রতিদানেরও আশা রাখি ইনশাআল্লাহ। এই তশকিলে আমরা রাজি আছি ইনশাআল্লাহ। [ইনশাআল্লাহ]।

এটাও মন তত সহজে ইনশাআল্লাহ বোঝার জিনিসও নয়! চিন্তা ফিকির করি, বারবার নিজের মধ্যে গিয়ে, একাকী নির্জনতার মধ্যে, শেষ রাতে। মন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জিনিস চাইবে। সাহাবারা (রা) যে হেদায়াত পেয়েছেন বহুত মূল্যবান কিছু দিয়ে পেয়েছেন। প্রিয় জিনিসগুলো দিয়েছেন, একবার নয় বরং বারবার দিয়েছেন, বহুবার দিয়েছেন। আর যা যা অত্যন্ত প্রিয় ছিল সেইসব জিনিসকে সম্পূর্ণ দিয়ে দিয়েছেন।

মক্কার মত প্রিয় জায়গা, এমনই দিয়েছেন যে ফাতাহ মক্কার পরে ফিরে গিয়ে প্রত্যেকেই নিজের বাড়ি আবার দখল করতে পারতেন। এখানে অনেকগুলো জিনিস আছে; শুধু বাড়ি দখল করা না। এক তো হল মক্কা, মক্কার বাড়ি দখল করা যেখানে প্রাণ লেগে আছে। দ্বিতীয় হল শত্রু আমার কাছ থেকে জবরদস্তি, অন্যায়ভাবে জুলুম করে ছিনিয়ে নিয়েছে। সেই প্রতিশোধও আছে। আরব ঐ কওম যেই কওম প্রতিশোধ ভালো করে জানে। আর প্রতিশোধের কথা একদিন দুইদিন, দশ বিশ বছর, এক পুরুষ দুই পুরুষে ভুলে যায় না। আর এখানে ঐ কওম, যার ওপর জুলুম করা হয়েছে, এখন সে প্রতিশোধ নিতে পারে, কমপক্ষে বাড়ি ফেরত নিতে পারে। কিন্তু কেউ গিয়ে ঐ বাড়ি ফেরত নেননি। জুলুম করে যে বাড়ি দখল করেছে, সেই বাড়ি তাদেরকে দান করে দেওয়া হয়েছে। ফেরত যাননি। শুধু বাড়ি যাওয়া নয়, নফসের কতবড় যজবাকে ছেড়ে দেওয়া। আথচ জুলুম করে নিয়েছে, দামও দেয়নি। কিন্তু ফেরত যাননি। যেসব কাফেররা দখল করেছিল, তাদের কাছেই রয়ে গেছে।

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) কোন প্রয়োজনে মক্কাতে রয়ে গিয়েছিলেন। বাকি সবাই মক্কা ফাতাহতে গিয়েছেন কিন্তু আবার মদীনায় চলে এসেছেন। অথচ মক্কায় বিজয়ী হিসেবে বাকি জীবন কাটাতে পারতেন; কিন্তু তা করেন নি। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) মক্কাতে রয়ে গেছেন, কিন্তু উনার নিজের আগের পুরনো বাড়িতে নয়, পুরনো মহল্লায়ও নয়। যদি কখনও সেই মহল্লা দিয়ে যেতে হত, তাহলে চোখের ওপর পর্দা দিয়ে দিতেন, যাতে সেই বাড়ি চোখে না পড়ে। হাদিসের মধ্যে যিনি এই কথা বলছেন, ‘রসূল (স) এর জীবনের পরে- আব্দুল্লাহ কখনও রসূল (স) কে স্মরণ করে নি চোখের পানি না ফেলে, কখনও নিজের মহল্লা দিয়ে যায়নি চোখের ওপর পর্দা না ফেলে।’ দুটো কথাকে একসাথে মিলিয়ে বলেছেন।  দুটোর মধ্যে সম্পর্ক কি? এই দুটো কথা একসাথে কেন বললেন? শুধু চোখের কারণেই? – বরং তার চেয়ে বেশি। এই যে রসূল (স) এর এই মুহাব্বত পেয়েছেন যে যখনই স্মরণ করতেন চোখে পানি আসত, এমনি থেকে নয়! কিছু দেওয়ার বিনিময়ে। প্রিয় কিছু দিয়েছেন, অন্য প্রিয় কিছু পেয়েছেন। আমরাও চাই, কিন্তু দিয়ে নিতে হবে। সেজন্য নিজেকে তশকিল করা। এটা ঐ চিল্লা, ৩ চিল্লার তশকীলের চেয়ে অনেক ভারী।

আব্দুল ওহাব সাহেব উনার কোন একজন বন্ধুকে (একজন ব্যবসায়ী) তশকীল করছেন- ঐ কথাই যে এই কাজকে নিজের কাজ বানাও। উনি কথা বুঝতে পেরেছেন, বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে বলেছেন আর উনিও ব্যবসায়ী মানুষ। অনেক পরে আব্দুল ওহাব সাহেবকে বললেন যে শোন আব্দুল ওহাব (সমবয়সী বন্ধু), তুমি যদি বল চিল্লা দিতে তো চিল্লা দিব, ৩ চিল্লা তাও দিব, বিদেশ সফরেও যাব। কিন্তু এই যে বলছ এই কাজকে কাজ বানাও ঐটা হবে না, আমার কাজ ব্যবসা। এইখানে টানাটানি করে লাভ নাই, চিল্লা-৩চিল্লা যত চাও দিয়ে দিব।

অনেকদিন আগে (প্রায় ২০ বছর আগে বা কাছাকাছি) আমি একবার ৩ দিনের জামাতে গিয়েছি। আমার এক ভাইও গিয়েছে। ঐ প্রথমবার আর সম্পূর্ণ ৩ দিনের জন্য বোধ হয় শেষ বার। ৩য় দিন মাগরিবের পরে আমি বয়ান করছি। আমার এক ভাগ্নেও গিয়েছিল, আমার পরিবার থেকে এই প্রথম ২ জন। আমার ভাগ্নে আর ভাই মজলিসে সবার সাথে বসে না, আলাদা আলাদা থাকে। তো বয়ানের সময় দুজন একটু পেছনে আলাদা বসেছে। বয়ানের ফাঁকে ফাঁকে কানে কানে কি সব কথাও বলে। পরে আমি জিজ্ঞেস করলাম যে কি কথা বলছিলে? আমার ভাই উত্তর দিল, যে ভাগ্নেকে কানে কানে বলছিল, যে ৩ দিনে যা দেখলাম- এরা তো দেখি সম্পূর্ণ চায়। [মজমা হেসে ফেলে]।

আমি জিজ্ঞেস করলাম যে সম্পূর্ণ চাওয়ার মানে টা কি? উনি নিজে বললেন যে দেখ, নামায পড়তে বলছ ঠিক আছে নামায পড়ব, যাকাত দিতে হবে তো যাকাত দিব, হজ্জ করতে হবে তো হজ্জ করব, তোমরা চাও জীবনেরই মালিকানা নিয়ে নিবে। [মজমা আবার হাসে]। জীবনের মালিকানা দিবনা। আমার জীবনের আমি মালিক, এর থেকে টুকরো টুকরো করে যা চাও দিব।

চিল্লা, ৩ চিল্লা এগুলো সব হচ্ছে ওখান থেকে কেটে কেটে দেওয়া, প্রফিট থেকে দেওয়া। আর এই যে তশকীল- “লান তানালুল বিররা…” , এইটা প্রফিট থেকে দেওয় নয়, বরং ক্যাপিটাল চাচ্ছে। আমাদের প্রত্যেকের একটা স্বপ্ন আছে, কল্পনা আছে। ঐটার মোকাবিলায় দু’আ করা, হে আল্লাহ, এই যে আমার মনের একটা স্বপ্ন আছে, একটা স্বাদ আছে, এইটা তুমি নিয়ে নাও আর আমাকে হেদায়াত দিয়ে দাও। এইটা ত মূলধনকেই দিয়ে দেওয়া। এইজন্য চিল্লা, তিন চিল্লার চেয়ে এইটা অনেক ভারী। যদিও কিছুই নয়, কল্পনার জিনিস; কল্পনা ধরেই তো মানুষ থাকে। এইজন্যে মন অত সহজে এইটার তশকীল হবে না। নিশ্চয়ই ইনশাআল্লাহ নিয়্যত করি, বলি, মেহেনত করি, দু’আ করি, নিজেকে বার বার করে তৈয়ার করি, মনকে ভাল করে বুঝাই। তৈয়ার আছি তো ভাই ইনশাআল্লাহ? [ইনশাআল্লাহ]।

চর্চা করি, মোজাকারা করি, আল্লাহ তাআ’লা মেহেরবানী করে দেবেন ইনশাআল্লাহ। বার বার করে এই কথাই জপছি। আল্লাহ তাআ’লা আমাদের সবাইকে বুঝার এবং করার তৌফিক দান করুন। [আমিন]। যদি ঠিকই নিজের প্রিয় জিনিসকে দিতে পারি; এটাই আসলে ইবাদত চায়। মাথা নত করা মানে এটাই। আমার সবকিছু দিয়ে দেওয়া।

শাহাদতের এত মূল্য কেন? শাহাদত তো শুধু প্রিয় জিনিস নয়, বরং প্রিয়-অপ্রিয় সবই তো দিয়ে দেওয়া; জীবনই যখন দিয়ে দিল। কিন্তু নফস এত জবরদস্ত যে ওখানেও ঠকানো জানে। মানুষের অনেক কিছুই আছে জীবনের চেয়েও বেশি প্রিয়। সুনাম; এগুলোর জন্য মানুষ জীবন পর্যন্ত দিয়ে দেয়। তাজমহল দেখে বহুত আগে কোন এক ইংরেজ মহিলা বলেছিল, “আমার কবরের উপরে এই রকম বানাতে রাজি হলে আমি এই মূহুর্তে মরতে রাজি আছি”। মানুষের নানান ধরণের চিন্তা কল্পনা এত বেশি মূল্যবান তার কাছে হয়ে যায় যে জীবন দিতে রাজি হয়ে যায়। আর এগুলো খুব বেশি দূরের জিনিস নয়। আমাদের দেশের অহরহ ঘটনাই- মানুষ তার জমি দখলের জন্য যান দিয়ে দেয়।

যদি মরেই গেল, ঐ জমির  ধান কে খাবে? কিন্তু কিছু একটা তার কাছে কল্পনায় আছে যেটা তার জীবনের চাইতেও বেশি মূল্যবান। ওটা ভাত খাওয়া নয়, ভাত তো খাবে না সে জানেই। এটুকু বুদ্ধি তার কাছে আছে। কিন্তু কিছু একটা চায়। তার সম্মান, তার দাপট, তার রাগ। ওর কাছে যাবে না; মরেই গেলাম কিন্তু ও যেন না পায়। অথচ এইসব ধরা যায়না, ছোঁওয়া যায়না, মাপা যায়না। মনের অনেক কিছুই আছে জীবনের চেয়েও বেশি মূল্যবান। কাফেরও তার জীবন দিতে রাজি হয়ে যায়। ঐ মূল্যবান জিনিসগুলো বা তার মধ্য থেকে কিছু যদি আল্লাহকে দিতে পারি, ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তাআ’লা বহুত বেশি দেনেওয়ালা। আমরা কি আর আল্লাহকে দেব; আল্লাহরই বা কি ঠেকা আছে? আর আমার পাত্রেই বা আছে কি? যদি আল্লাহকে আমার মাপের মূল্যবান জিনিস দিতে রাজি হই, ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তাআ’লা তাঁর মাপের মূল্যবান সম্পদ দিবেন।

سُبْحَانَ اللّهِ وَ بِحَمْدِهَ

سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْك

سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُون وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينََ

অডিও ডাউনলোড লিংক

https://www.dropbox.com/s/c7w79zd10hvc21i/%E0%A6%86%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%95%E0%A7%87%20%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%AF%E0%A6%BC%20%E0%A6%9C%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B8%20%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%93%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%BE.mp3.mp3?dl=0

(লিখেছেন ভাই আবু মুশফিক)